ডিপ্রেশন বর্তমান সময়ে একটি বড় সমস্যা, এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্যে সকলেরই ডিপ্রেশন এর ধরণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে জানা উচিৎ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এর মতে স্বাস্থ্য হল ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়।
সুতরাং আমরা বলতে পারি, একজন মানুষের স্বাস্থ্য হল রোগবালাই মুক্ত সুস্থ শরীর ও সেই সঙ্গে ভয়, হতাশা, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত মন এবং সমাজের নানাবিধ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে সক্ষম মন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান হল মনের সুস্থতা বা মানসিক স্বাস্থ্য।

মানুষের চিন্তা, আবেগ ও আচরণ এই তিন মিলেই হল মানসিক স্বাস্থ্য। আমরা শারীরিক রোগ নিয়ে যেমন খুব উৎকণ্ঠিত হয়ে যাই, ঠিক বিপরীত কাজ করি মানসিক রোগের বেলায়। এখন পৃথিবীর প্রতি চার জনের মধ্যে একজন জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে মানসিক রোগে ভুগে থাকে, আজকে আমরা জানবো ডিপ্রেশন এর ধরণ এবং প্রতিকার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকট সৃষ্টি করবে এ মানসিক ব্যাধিটি তথা ডিপ্রেশন। তারা এক জরিপে উল্লেখ করেছেন, নিম্ন-আয়ের বা মধ্যম আয়ের দেশে বসবাসকারী ৭৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ বিষণ্ণতার চিকিৎসা নিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।
Institute for Health Metrics and Evaluation (IHME) এর Global Burden of Disease Study 2016 থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪.৪৪% লোক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত; যার মধ্যে পুরুষের তুলনায় মহিলার সংখ্যা ২% বেশী। কিন্তু এই সংখ্যা আরও অনেক বেশী। কারণ সামাজিক ট্যাবুর জন্য আমরা অনেকেই এই জিনিস নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা।
ডিপ্রেশন করেক ধরনের আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

১) Major Depressive Disorder (MDD) – একে আবার ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনও বলা হয়। এই ডিপ্রেশনে পাঁচটা প্রধান লক্ষণ হলো বিষণ্নতা, শূন্যতা, ব্যর্থতা, অকর্মণ্যতা, এবং অপরাধবোধ। এইগুলো যদি নূন্যতম দুই সপ্তাহের বেশী থাকে তাহলে সে MDD তে আক্রান্ত বলে ধরা হয়।
এই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে উপসর্গ দেখা যায় তা হলো ক্ষুধামন্দা, ওজন কমে যাওয়া, ঘুম না হওয়া, কোন কাজে এনার্জি না পাওয়া ইত্যাদি। এই উপসর্গ প্রকট আকার ধারন করলে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টাও শুরু করে। এই ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই নেওয়া প্রয়োজন।
২) Persistent depressive disorder এর আগের নাম ছিলো “Dysthymia”. এই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত তাঁকেই ধরা হয় যার মধ্যে “লো মুড” অনুভূতি কমপক্ষে দুই বছর ধরে বিদ্যমান থাকে এবং তা মেজর ডিপ্রেশনে পরিণত হয়না।
এই ডিপ্রশনে আক্রান্ত ব্যক্তি নরমাল জীবন যাপন করতে পারলেও তাঁর মধ্যে একটা নিরানন্দ অনুভূতি কাজ করে। এর সাথে অন্য উপসর্গ যা দেখা দিতে পারে তা হলো খাওয়া ও ঘুমের পরিবর্তন, হতাশা।
৩) Bipolar disorder এর অপর নাম হলো “Manic Depressive Disease. Bipolar Disorder হলো আবেগজনিত মানসিক রোগ। এই রোগ ডিপ্রেশন ও আবেগ উদ্দীপনার এক যুগলবন্দী বলেই একে বলা বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে।
একদিকে যেমন বিষণ্নতায় কোন কিছু ভালো লাগেনা। অন্যদিকে তখন অস্বাভাবিক উত্তেজনা ও এনার্জি অনুভূত হয়। এর উপসর্গ গুলো হলোঃ বিশাল কল্পনা, অস্বাভাবিক আত্মমর্যাদাবোধ, ঘুমের স্বল্পতা, ক্ষুধা ও জৈবিক কাজে আগ্রহ কমে বা বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত কর্ম তৎপরতা, অতিরিক্ত আনন্দ অনুভূত হওয়া ইত্যাদি। এসব কোন অনুভূতি বেশী সময় থাকেনা যা আবার কখনও আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে।
8) Seasonal affective disorder (SAD ) – এই ডিপ্রেশন সাধারণত দেখা দেয় শীতকালে বিশেষভাবে বলতে গেলে শীতপ্রধান দেশে এই ডিপ্রেশন বেশী দেখা যায়। সাধারণত শীতকালে দিন ছোট হয়ে যাওয়া ও সূর্যের আলো কম পাওয়া থেকেই এই ডিপ্রেশন তৈরি হয়। আর শীতে শেষে বসন্ত আসলে সাধারণত চলে যায়। তবে এই ডিপ্রেশনও যদি প্রকট আকার ধারণ করে তবে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
এছাড়াও আরও দুইটা প্রধান ডিপ্রেশন বা মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় তা হলোঃ

১) Peripartum or Postpartum Depression – মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সি থেকে শুরু করে বাচ্চা জন্মের এক বা দুই বছরের মধ্যে এই ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। প্রতি সাত জনের মধ্যে একজন Postpartum Depression এ ভুগে। এই ডিপ্রশনে আক্রান্ত মার সাথে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাচ্চা এবং পুরা পরিবার। এই ডিপ্রেশনের ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পাশাপাশি পরিবারের একটা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা হয়েছে।
2) Premenstrual Dysphoric Disorder (PMDD) – সাধারণত এই ডিপ্রেশন ওভুলেশানের পর থেকে menstrual period পর্যন্ত থাকে। এর উপসর্গ হলো তিরিক্ষি মেজাজ, অবসাদ, বিরক্তভাব, food cravings ইত্যাদি। এই ডিপ্রেশন যদি মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করলে হরমোনাল ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন হয়।
রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট-এ মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনের কিছু লক্ষণ চিহ্নিত করেছে। তারা বলছেন, এই লক্ষণগুলো দুই সপ্তাহ বা তারচেয়েও অধিক সময় থাকলে ধরে নিতে হবে আপনিও মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন।
লক্ষণগুলি হলো:
> সবসময় মন খারাপ লাগে (সন্ধ্যার দিকটা একটু ভালো লাগতে পারে)
> কিছু করতে ইচ্ছা করে না আর কিছু করতে ভালো লাগে না
> যে কাজ আপনি সহজেই করতে পারতেন, তা করে উঠতে না পারা
> কোন ব্যপারে মনস্থির করতে সময় লাগে
> খুব ক্লান্ত লাগা
খুব অস্থির লাগা
> ক্ষুধা না পাওয়া আর ওজন কমা (কিছু ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হয়, খাওয়া বেড়ে যায় আর ওজন বেড়ে যায়)
> একঘন্টা বা দুঘন্টা লাগে ঘুম আসতে, তারপরেও সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়া
> সহবাসে অনিচ্ছ
> আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং আস্থা হারানো
> নিজেকে অপদার্থ বা অকর্মণ্য মনে করা
অন্যদের সঙ্গ বর্জন করা
> বিরক্ত লাগা
> দিনের কোনো এক সময় বেশি বিষন্ন থাকা (সাধারণতঃ সকালে)
> আত্মহত্যার কথা ভাবা
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপারগুলো হলোঃ
১) নিজের ভিতরে চেপে না রাখা যদি কোনো খারাপ খবর পেয়ে থাকেন, বা কোনো মানসিক আঘাত পেয়ে থাকেন, তবে কোনো নিকটজনকে আপনার মনের কথা খুলে বলুন। অনেক সময়ে দুঃখের কথা বললে, সেই নিয়ে কান্নাকাটি করলে, মনটা হালকা হয়। এটা মনকষ্ট লাঘব করবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
২) নিজে কিছু করা – বাইরে বের হয়ে একটু হাঁটাচলা করুন। আপনি শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকবেন এবং ঘুমটা
হয়তো ভালো হবে। হয়তো আপনি কাজ কিছু করতে পারবেন না, কিন্তু শারীরিক সুস্থতাও প্রয়োজন। টুকটাক কিছু
কাজ করুন, হয়তো ঘরের কাজ করলেন বা দৈনন্দিন জীবনের সামান্য কিছু করলেন। যে কষ্টকর চিন্তা আপনার মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে, তার থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বিরাম পাবেন।
৩) ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করা – বিষাদরোগ হলে আপনার ওজন কমতে পারে, এবং ভিটামিনের অভাব দেখা যেতে পারে। এতে আরো বাড়ে বিষণ্ণতা। হয়তো খেতে ইচ্ছা করছে না, তবুও যতখানি সম্ভব সুষম খাদ্য খাওয়ার চেষ্টা করুন। টাটকা ফল বা তরিতরকারি বিশেষভাবে উপকারী।
৪) ব্যায়াম করা – সপ্তাহে অন্তত ৩ থেকে ৫ দিন আধঘণ্টা সময় আমরা ব্যয় করতে পারি ব্যায়ামের জন্য। বিভিন্ন গবেষকের মতে, শরীরচর্চা বা ব্যায়াম শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে যা দেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র শান্ত রাখে। দেহের এন্ডোরফিন নামক হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায় যা মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। দেহের ইমিউন সিস্টেমের যে অংশগুলো ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দেয়, সেগুলোর প্রভাব কমায়।
৫) সিগারেটকে না বলা – সিগারেট আর ডিপ্রেশন একে অপরকে স্থায়ী করে তোলে। ডিপ্রেশন থেকে দূরে থাকতে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে হবে।
৬) মদ থেকে সাবধান – কষ্ট কমানোর জন্য নিজেকে মদের মধ্যে ডুবিয়ে দেবেন না। মদ আসলে বিষণ্নতা বাড়ায়। মদ্যপানে কিছু সময়ের জন্য ভালো লাগলেও অধিক মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। মদে আপনি আপনার সমস্যাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আসলে আপনার উচিৎ, প্রয়োজনে সাহায্য নিয়ে আপনার সমস্যাটার
সমাধান করা।
৭) ঘুম – ঘুম আসবে কি আসবে না, সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। রেডিও শুনতে পারেন অথবা শুয়ে শুয়ে রিল্যাক্স করে টিভি দেখতে পারেন। অন্যদিকে মন থাকলে আপনি সহজে রিল্যাক্স করতে পারবেন এবং আপনার ঘুম তাড়াতাড়ি আসবে।
৮) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা বেশকিছু গবেষণা বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার ডিপ্রেশনের কারণ হতে পারে এবং আত্মসম্মানবোধ কমিয়ে দিতে পারে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার কমিয়ে পরিবার, বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের বেশি সময় দেওয়া উচিত।
৯) ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভালো করে জানা যে ওষুধ খাওয়া হচ্ছে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো আগে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। এমন কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ডিপ্রেশন বাড়তে পারে। তাই, যেকোনো ওষুধই চিকিৎসকের পরামর্শমতো খাওয়া উচিত এবং ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ডিপ্রেশন হতে পারে কি না সেটা জেনে নেওয়া উচিত।
১০) বিষণ্নতার কারণের প্রতিকার করা – যদি আপনি জানেন যে কেন আপনি বিষণ্ণ বোধ করছেন, তাহলে সেটা লিখে ফেলুন। তারপরে ভাবুন যে আপনি কী কী ভাবে এর প্রতিকার করতে পারেন। যেগুলি করা সম্ভব সেগুলি করে দেখতে পারেন।
১১) জীবনে আশা রাখা মনে রাখবেন আপনি একা নন, আরো অনেক লোকের এই এক অনুভূতি হয়। এখন বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু এই অনুভূতি একদিন কেটে যাবে। যখন বিষণ্নতা কেটে যাবে, তখন আপনি আরো মানসিক দৃঢ়তা লাভ করবেন। সহজে সমস্যার মোকবিলা করতে পারবেন এবং দৃষ্টিভঙ্গি আরো স্বচ্ছ হবে। হয়তো আপনি জীবনে কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারবেন, যা আপনি আগে এড়িয়ে গেছেন।
ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। অনেকেই কঠিন এই মানসিক ব্যাধির সঙ্গে দিনের পর দিন লড়াই করেন নিজের অজান্তেই। তারা টেরই পান না যে ডিপ্রেশনে ভুগছেন। শুধু যে বড়দের মধ্যেই ডিপ্রেশন দেখা দেয় তা কিন্তু নয় ছোটরাও এই ব্যাধির কারণে নানা ভুল কর্মকাণ্ড করে বসে।
দীর্ঘদিন এই ব্যাধি পুষে রাখলে তা মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত বাড়াতে পারে। কারণ বিষণ্নতার কারণে প্রতি বছর বিশ্বে আত্মহননে মারা যাচ্ছে লাখো মানুষ। তাই সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা করা জরুরি।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনার পারিবারিক ডাক্তার আপনার বিষাদরোগের চিকিৎসা করবেন। আপনার লক্ষণ দেখে, লক্ষণের তীব্রতা দেখে তিনি স্থির করবেন আপনার কী প্রয়োজন, বিষাদ প্রতিরোধক ট্যাবলেট, কথা-বলা চিকিৎসা, কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি বা দুটোই।
আপনি যতই বিষণ্ণ হোন না কেন, আপনার অনুভূতির কথা বলতে পারলে উপকার পাবেন। আসুন আমরা ডিপ্রেশন এর ধরণ এবং প্রতিকার নিয়ে জানি এবং আমাদের আশেপাশে থাকা মানুষগুলোকে সাহায্য করি এর থেকে মুক্তির জন্য। আমাদের কাছে লেখাটি পাঠিয়েছেন ডাঃ বি. রয়।
স্বাস্থ নিয়ে আমাদের ব্লগ গুলো পড়তে ক্লিক করুন। আমাদের হেলথ প্যাকেজ সম্পর্কে জানতে ভিজিট করুন।